
আমরা গিয়েছিলাম খুলনা হয়ে।রুট ছিলো
ঢাকা-খুলনা-করমজল-সুন্দরবন।
আমাদের ট্যুর ছিলো ৩দিন ৩রাতের।
গত বছর ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ রাতে আমরা যাত্রা শলশুরু করি।আমাদের ট্রেন ছিলো চিত্রা এক্সপ্রেস। তখন ঐ সময়টাতে আবহাওয়া খুবই খারাপ ছিলো।সমুদ্র উত্তাল।তারপরও আল্লাহ্রর নাম নিয়ে রওনা হলাম।
খুলনা স্টেশনে পৌছালাম ১৯তারিখ ভোর ৫টায়।স্টেশন থেকে খুলনা লঞ্চ ঘাটের দূরত্ব পায়ে হেঁটে ৭-৮মিনিট।
লঞ্চে যেয়ে রুমের চাবি নিলাম।আমাদের রুম ছিলো দোতালায়।ফ্রেশ হয়ে দিলাম এক ঘুম।ঘুম থেকে উঠে দেখি সকাল ৮টা বাজে।অনেক দূর চলে এসেছি।রূপসা ব্রিজটা মিস হয়ে গিয়েছে।কিন্তু তখনো রূপসা নদীতেই ছিলাম।
মংলা পার হলাম।বিশাল বিশাল জাহাজ, মংলা সিমেন্ট কারখানা,আর একটু দূরে দেখা যায় রামপাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র।এরপর পশুর নদী।নদীতে কিছুক্ষণ পর পরই শুশুক ডলফিন ভেসে উঠছিলো।
১ম দিন:
♣প্রথম স্পট:করমজল
এখানে হরিণ ও কুমির প্রজনন কেন্দ্র রয়েছে।কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে বিষয় সেটা হচ্ছে করমজলের বানরগুলো খুবই বান্দর।যার কাছে যে খাবার দেখছে সেটাই কেড়ে নিচ্ছিলো।
এছাড়া এখানে রয়েছে বনের ভিতর দিয়ে সরু কাঠের রাস্তা।রাস্তার দুপাশে সবুজ গাছপালা, শ্বাসমূল,আর মাটিতে প্রচুর হরিণ আর শুকরের পায়ের ছাপ।
♣দ্বিতীয় স্পট:হাড়বাড়িয়া
হাড়বাড়িয়া গিয়ে প্রথমে যেটা চোখে পড়ল সেট হচ্ছে গোলপাতা গাছ আর গোলফল।প্রচুর গোল ফল গাছগুলোতে।স্থানীয় লোকদের মতে এই গোলগাছের আড়ালেই রয়েল বেঙ্গল রাইগার লুকিয়ে থাকে।এছাড়া এখানে রয়েছে লাল পদ্মে ভরপুর এক পুকুর।করমজলের মত এখানেও কাঠের রাস্তা রয়েছে বনের ভিতর দিয়ে।যা ঘিরে রয়েছে অসংখ্য গোলপাতা গাছ।এখানেই আমরা প্রথম একটা মা বাঘিনী আর দুটো বাচ্চা বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পাই।
হাড়বাড়িয়ার মধু অনেক ভালো।মধু কিনলে এখান থেকেই কেনা ভালো।
দ্বিতীয় দিন:
♣জামতলা বিচ:
ভয়ঙ্কর সুন্দর যাকে বলে এই বিচ সেটাই।এখানে যেতে হলে যাওয়া আসায় মোট প্রায় ৬মাইল পায়ে হাটতে হবে।এখানে যেতে হয় জঙ্গলের ভিতর দিয়ে।খুব সুন্দর ছোট একটি পুকুরও আছে এখানে।প্রচুর অবাধে ছুটাছুটি করা হরিণের দেখা মিলবে এখানে।
এই বিচের পাশে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগে বিধ্বস্ত বিশাল বিশাল গাছের গুড়ি পড়ে থাকতে দেখা যায়।এখানকার পানির রং একটু কালচে ধরণের।
আর ভাগ্য যদি ভালো হয় তাহলে দেখা মিলে যেতে পারে ইরাবতী ডলফিনের।আমরা যতক্ষণ ছিলাম সেই পুরোটা সময় জুড়েই একটি ডলফিল পানিতে লাফাচ্ছিলো।আসলেই অসম্ভব সুন্দর একটা জায়গা।
♣২য় স্পট:কটকা অফিস পাড়
এখানে সবচেয়ে বেশি হরিণ দেখে ছিলাম আর সাথে ছিলো বন্য শুকর।ভোর বেলা যখন আমাদের লঞ্চ পাড়ে থেমে ছিলো তখন আমাদের গ্রুপের একজন এখানে একজোড়া বাঘ দেখেছিলো এই কটকাতেই।কটকা বিচের পাড়ে অসংখ্য ঝিনুক পড়ে থাকে।
আর বিচের পাশে একটি পরিত্যক্ত বিল্ডিং এ দেখা মেলে বিশাল এক তিমির কঙ্কালের।স্থানীয়রা জানায় সিডরের সময় এই তিমি এখানে আটকে পড়েছিলো।
৩য় দিন:
♣হিরণ পয়েন্ট
এটি নীলকমল নামেও পরিচিত।এখানে আসারসার পথে দেখলাম বিশাল একক কুমির পাড়ে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে। তার কিছু দূরেই জঙ্গলের পাড় ঘেষে মোয়ালরা নৌকায় রান্না করছে।যেকোনো মুহূর্ততে বাঘ বা কুমির তাদের আক্রমণ করতে পারে।কি অদ্ভুত অনিশ্চিত জীবন।
প্রচুর গাছপালায় পরিপূর্ণ হিরণপয়েন্ট।সরু কাঠের রাস্তা,গরান,গেওয়া,সুন্দরী, তারপর একটু বসার জায়গা,সব মিলিয়ে সবুজে ঘেরা এক মনোরম পরিবেশ।

তিমির কঙ্কাল
♣কচিখালী:
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে যেমনটা দেখায় সুন্দরবন সরু নদী চারপাশে ঘন জঙ্গল সেটাই কচিখালী।এটা মূলত একটি খাল যেখানে নৌকায় করে চারপাশ ঘুরা যায়।এখানে ঘুরার সময়ই দেখা মিলতে পারে সাপ,গিরগিটি আরও বিরল কিছু প্রানি।আমরা বন মোরগ আর গুইসাপ দেখেছিলাম।
♣দুবলার চর:
আমাদের এই ট্যুরের সবচেয়ে সুন্দর আর শেষ স্পট ছিলো দুবলার চর,মূলত এর কারণেই সুন্দরবনের প্রেমে পড়ে যাই।
অসম্ভব সুন্দর একটি দ্বীপ,মাছ ধরার জন্য বিখ্যাত।আমরা নৌকা থেকে দ্বীপে নেমেই দেখলাম অসংখ্য হাঙরের বাচ্চা তীরে পড়ে আছে।আর জীবন্ত সাপ।এছাড়া অামরা একটা মৃত অক্টোপাসও দেখেছিলাম।
যারা শুটকি মাছ পছন্দ করেন তারা নিশ্চিতে এখান থেকে কিনতে পারেন।এখানে চারিদিকে শুধু শুটকি আর শুটকি আর দাম তুলনামূলক কম,একদম ফ্রেস,আর মেডিসিন ফ্রি।
এই দ্বীপের পূর্বাংশে পশুর নদী,পশ্চিমাংশে শিবসা নদী আর অন্য পাশে বঙ্গোপসাগরের অপরূপ সৌন্দর্য।
এখানে সাগরের পানিতে অনেক জেলীফিস।পানিতে হাত দিলেই ছোঁয়া যায়।
এতো নির্জন,পরিপাটি, সুন্দর দ্বীপ আর দেখিনি।
এখানে স্থানীয় কোনো লোক নেই।যারা আছে তারা চার মাস এখানে থাকে,ব্যবসা করে চলে যায়।
লঞ্চের খাবার খুবই সুস্বাদ।একবারে ১০/১০।আর তাদের স্টাফরাও খুবই আন্তরিক।
১ম দিন:
★সকালের নাস্তা-
পরোটা+সবজি+ডিম+☕চা/কফি
★১১টায় হালকা নাস্তা-
কেক+কলা+☕চা/কফি
★দুপুরের খাবার-
ভাত+সবজি+মুরগি+ভেটকি মাছ+ছালাদ
★বিকেলের নাস্তা –
নুডুলস+☕চা/কফি
★রাতের খাবার-
ভাত+সবজি+মুরগি+রুই মাছ+ছালাদ
২য় দিন:
★সকালের নাস্তা
ভুনা খিচুরি+ডিম ভুনা+আচার+ছালাদ
★১১টায় হালকা নাস্তা
ফল+পুরি+☕চা/কফি
★দুপুরের খাবার
ভাত+সবজি+ফাইশ্যা মাছ+মুরগি+ডাল+ছালাদ
★বিকেলের নাস্তা
নুডুলস+☕চা/কফি
★রাতের খাবার
নান রুটি+ফ্রাইড রাইস+চিকেন বারবিকিউ+ফিস বারবিকিউ+ভুনা ডাল+রাশিয়ান ছালাদ+কোলড্রিংক্স
৩য় দিন:
★সকাল:
পরোটা+ডিম+সবজি+☕চা/কফি
★হালকা নাস্তা:
পুরি +বিস্কুট+চা
★দুপুর:
বিরিয়ানি+ডিম+দই+সালাদ+ড্রিংক্স
★বিকেল
ছোলা+মুড়ি+চা +বিস্কুট
★রাত
ভাত+সবজি+মুরগি+মাছ+সালাদ
সুন্দরবন ভ্রমণের উপযুক্ত সময় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী।কারণ এসময় আবহাওয়া এখানার জন্য অন্য সময় থেকে ভালো।জনকোলাহল বিহীন ট্যুরর একে বলা যেতেই পারে।
আমাদের ট্যুরটা ছিলো একদম রিল্যাক্স ট্যুর। যান্ত্রিক জীবন থেকে দূরে নিরিবিলি এর মত আর কি হতে পারে।লঞ্চে সবচেয়ে সুন্দর প্রশান্তির সময়টা সন্ধ্যা হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্ত থেকে সারা রাত।এক কাপ রং চা আর সাথে সমুদ্রের বিশালতায় হারিয়ে যাওয়া।
কেউ যদি সস্তায় টাইটানিকের ফিল নিতে চান then this is definitely the exact place.♥
আমার রুম ছিলো দোতালায়।বেডে শুয়ে শুয়ে সাগর উপভোগ করা আর রুমের পাশে বিশাল বারান্দার মত লঞ্চের সামনের জায়গা টুকু সন্ধ্যায় যেখানে দাঁড়ালে একবার হলেও টাইটানিকের কথা মনে পড়বে।সাথে চা বা কফিও নিতে পারেন।প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস থাকে প্রায় সবসময়।শীতের কাপড় পড়েও মনে হচ্ছিও বাতাস হাড়ে লাগছে,তাই শীতের কাপড় নিতে হবে অবশ্যই।
সুন্দরবনে শুধু টেলিটকের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।কিন্তু কটকার পর সেটাও পাওয়া যায় না।প্রয়োজনীয় যোগাযোগ তাই আগেই শেষ করে নেওয়া ভালো।
আমরা ছিলাম মোট ৭৬জন।লঞ্চে তাই বাইরের অপরিচিত কেউ ছিলোনা।
তিন দিন তিন রাত লঞ্চে থাকা+খাওয়াসহ মোট লেগেছিলো ৩২০০০০ টাকা।এটা একেক এজেন্সির একেক রকম।কিন্তু লোক যত বেশি হবে খরচ তত কমে আসবে।
সুন্দরবন আমাদের অতি মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ।সুন্দরবনে যেয়ে যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা বা অপ্রয়োজনীয় জিনিস ফেলবেন না।বনের ভিতর যেয়ে কোনো প্রাণি দেখে জোড়ে চিৎকার বা কথা বলবেন না।এতে বন্য প্রাণীরা ভয় পায়।আর হরিণকে খাওয়ানোর জন্য বা অযথা গাছের পাতা বা ফলমূল ছিড়বেন না।
লেখাঃ Anika Tasnim